নিজস্ব প্রতিবিদক :
আজ ২ ডিসেম্বর। ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির রজতজয়ন্তী। দীর্ঘ ২৫ বছর আগে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএস) মধ্যে দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে সশস্ত্র আন্দোলন চলার পর ঐতিহাসিক এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য অধিবাসীর পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা বিশ্ব জুড়ে প্রশংসিত।
চুক্তির পর ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে শান্তিবাহিনীর শীর্ষ গেরিলা নেতা সন্তু লারমা তার বিপুলসংখ্যক সহযোগী নিয়ে অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। সরকার তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ প্রদান করে। পার্বত্য চুক্তির সর্বমোট ৭২টি ধারা রয়েছে। চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ইতিমধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত, ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বদলে গেছে পাহাড়ের চিত্র। অচিন্তনীয় উন্নয়ন হয়েছে পাহাড়ের তিন জেলায়। বিশেষ করে যোগাযোগব্যবস্থায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। দেশ যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, এর সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিয়ে সবুজের পাহাড়ও এগিয়ে যাচ্ছে। গহিন অরণ্যেও মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক পাহাড়বাসীর জন্য এক অনন্য প্রাপ্তি। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন খাতে যেমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন রয়েছে, তেমনি বেসরকারি পর্যায়েও থেমে নেই। এসবের মধ্যেও তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আজ দিনটি পালন করবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর পার্বত্য জেলায় দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ নেয়। সরকার পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক হলেও অপর পক্ষ মাত্র দুটি চুক্তি এখনো বাস্তবায়ন করেনি। চুক্তি দুটি হলো—আত্মসমর্পণকারী জেএসএসের সশস্ত্র সদস্যের তালিকা এবং অস্ত্র জমা দেওয়া। আত্মসমর্পণকারীর তালিকা ও অস্ত্র জমা না দেওয়ায় পার্বত্য চুক্তির ২৫ বছর পরেও থামেনি সংঘাত।
এই সংঘাত হওয়ার পেছনে রয়েছে সন্তু লারমার অবৈধ অস্ত্রের মজুত। পার্বত্য চুক্তির নামে সন্তু লারমা সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে অস্ত্রের ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আখড়া তৈরি করে রেখেছে পাহাড়ে। তিনি চুক্তির শর্তের সঙ্গে প্রতারণা করে কিছুসংখ্যক ভাঙাচোরা পুরাতন অস্ত্র জমা দিয়ে ভালো অস্ত্রগুলো নিজের কাছে মজুত রেখেছেন। এছাড়া চাঁদাবাজির মাধ্যমে নতুন নতুন অস্ত্রের জোগান দিয়ে চলেছে সংগঠনটি। চুক্তি ভঙ্গকারী সংগঠনটির অবৈধ অস্ত্র ও চাঁদাবাজির কারণেই বিভিন্ন দুর্গম জায়গায় আজ হানাহানি, যুদ্ধবিগ্রহ, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজমান। পার্বত্য চুক্তির আগেও পাহাড়িরা ব্যাপকভাবে চাঁদাবাজি করত, আর চাঁদা দিতে অসমর্থ হলে তাকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া এবং খুন, গুম, অপহরণ, মুক্তিপণ, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি ও শস্যের খেত পুড়িয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সম্প্রীতি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্ত অবস্থানের কারণে জেলা ও উপজেলা শহরে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে বা দুর্গম এলাকায় চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
পার্বত্য তিন জেলায় শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েকটি। পার্বত্য চুক্তির পর মেডিক্যাল কলেজসহ ১৭৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে উপজাতি ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ কোটার সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রতি বছর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩২৫ জন উপজাতি ছাত্রছাত্রী বিশেষ কোটায় ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। পাবলিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর সংখ্যা আরও বাড়ানো হয়েছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও বিশেষ কোটার ব্যবস্থা রয়েছে পার্বত্য উপজাতিদের জন্য। সরকার পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী সবকিছুই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে এবং করে যাচ্ছে। অন্যদিকে সন্তু লারমা তার বিপরীত। সন্তু লারমা পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী কিছু তো করেনই নাই, বরং চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ের মতো আরও খারাপ করে যাচ্ছে বলে বাঙালি ও পাহাড়িদের অভিযোগ। সন্তু লারমা ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী পার্বত্য চুক্তির অপব্যবহার করেছে গত ২৫ বছর ধরে। একই সময়ে তারা চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, ধর্ষণ এবং অসংখ্য মানুষ হত্যা চালিয়ে যেতে থাকে। আর্থসামাজিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-চিকিৎসা, ব্রিজ, কালভার্ট ও রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন, মোবাইল ব্যাংকিং, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেটের ব্যবস্থা, পর্যটনশিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন, দুর্গম পাহাড়ে বিদ্যুতায়ন, যেখানে বিদ্যুতায়ন সম্ভব হয়নি সোলার প্যানেল বিতরণ, মহামারি কোভিড-১৯ টিকা কার্যক্রম, মৃত্যুপথযাত্রী মুমূর্ষু রোগীদের হেলিকপ্টারে স্থানান্তর, মানবিক সহায়তার অংশ হিসেবে খাদ্য, বস্ত্র ও বিশেষ বাড়ি বিতরণ, বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা, ওষুধ বিতরণসহ নানামুখী উন্নয়নমূলক ও দৃশ্যমান কার্যক্রম সরকার ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিরলসভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। তদুপরি কতিপয় স্বার্থন্বেষী মহলের ওপর রচনা এবং মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন সামগ্রিক পরিবেশকে নষ্ট করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্যে দিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিঃসন্দেহে বাংলাদেশরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ দেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং অপরাপর উপজাতি যারা আছে তাদের প্রতি আমাদের বাঙালিদের তথা সরকারের যথেষ্ট সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও কতিপয় দেশদ্রোহী সুশীল সমাজ, আন্তর্জাতিক এনজিও, জাতীয় এনজিও ও খ্রিষ্টান মিশনারিদের ছত্রছায়ায় অত্র অঞ্চলে পার্বত্য শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। তদুপরি আলাদা জুম রাষ্ট্র গঠন এবং নিজেদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, যা নিঃসন্দেহে অমূলক ও অনৈতিক একটি দাবি বলে পরিগণিত পাহাড়ি ও বাঙালিদের কাছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিলুপ্তযোগ্য রাজ্যপ্রথার তথাকথিত দেশদ্রোহী রাজাকার রাজা ত্রিদিব রায়ের বংশধর ও তার পরিবারের সদস্যরা এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি ও জুম্ম ল্যান্ড প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
চলতি বছর পর্যন্ত পার্বত্যাঞ্চলে সহিংস ঘটনায় বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ১ হাজার ১৪০ জন উপজাতি, ১ হাজার ৪৪৫ জন বাঙালি নিহত, ২ হাজার ৬৩৩ জন আহত ও ২ হাজার ৯৪৩ জন অপহরণ হয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ১৭১ জন সেনাবাহিনীর সদস্য, ১১১ জন বিজিবি, ৩২ জন পুলিশ ও ৬৬ জন আনসার ও ভিডিপি সদস্য জীবন দিয়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আহত হয়েছেন ৪৫৮ জন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি দিবস ২০২২’ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘শান্তিচুক্তির ফলে পার্বত্য জেলাগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথ সুগম হয়েছে। এ বছর দিবসটির রজতজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে আমি বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।’
বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র শান্তি বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। আমি আশা করি, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব, ইনশাল্লাহ।’